জাল ছবি দেখিয়ে ডেরেক জড়িয়ে দিলেন দিদিকেও

একের পরে এক অস্বস্তি বেড়েই চলেছে তৃণমূল কংগ্রেসের। এবার নতুন বিতর্ক। আর সেটা তৈরি করলেন দলের জাতীয় মুখপাত্র স্বয়ং।
নারদ-কাণ্ডের ভিডিও’কে যিনি ‘জাল’ বলে দাবি করেছিলেন, সেই ডেরেক ও’ব্রায়েনই জড়িয়ে গেলেন ‘জাল ছবি’র কারবারে!
তৃণমূলের ‘পোস্টারবয়’ ডেরেকের লক্ষ্য ছিল নির্বাচনের সময় বিজেপি-সিপিএমের ‘ঘনিষ্ঠতা’ প্রমাণ করে বিরোধীদের ‘চাপে’ ফেলা। ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত হয়, কম্পিউটারের ‘ফটোশপে’ ছবি ‘জাল’ করা হয়েছে। অতঃপর তড়িঘড়ি ভুল প্রকাশ করা হয় শাসকদলের তরফে। গোটা ঘটনার ‘দায়’ চাপানো হয়েছে তৃণমূলের ‘রিসার্চ টিমে’র উপর! বিজেপি অবশ্য তার আগেই পুলিশের কাছে অভিযোগ করার কথা জানিয়ে দিয়েছে। দাবি উঠেছে ডেরেকের গ্রেফতারি এবং রাজ্যসভার সাংসদপদ থেকে ইস্তফারও।
গোটা ঘটনায় প্রবল ‘বিড়ম্বনা’য় শাসকদল। কোনও ‘দায়িত্বশীল’ নেতাই ওই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে চাননি।

শনিবার সকালে ডেরেক তাঁর বাড়িতে একটি সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন। তিনি জানিয়েছিলেন, তিনি সাংবাদিক বৈঠকটি ডেকেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশেই! সেখানে ডেরেক অভিযোগ করেন, সিপিএম-কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপি’র ‘আঁতাঁত’ রয়েছে। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণে দু’টি ‘ভিডিও ক্লিপিং’ এবং ছ’টি ছবি দেখান ডেরেক। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কেরলে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী বলছেন, ‘‘বামপন্থীরা যে মতাদর্শে বিশ্বাস করেন, তা এখন অচল।’’
এরপর এ রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে আসা রাহুলের বক্তৃতার একটি ভিডিও ফুটেজ দেখান ডেরেক। সেখানে দেখা যায়, বাম-কংগ্রেস জোটের হয়ে ভোট চাইছেন রাহুল। ভিডিও ফুটেজ দু’টি দেখানোর পর রাহুলকে কংগ্রেসের ‘আশ্চর্য বালক’ বলে কটাক্ষ করেন ডেরেক। রাহুলের উদ্দেশে তির্যক মন্তব্য করেন, ‘‘বড় বড় কথা বলে মানুষকে ঠকানোর চেষ্টা করছেন!’’
এরপর ডেরেক টিভি’র পরদায় স্থিরচিত্রগুলি দেখান। একটি ছবিতে দেখা যায়, হাতে গ্লাস নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কংগ্রেস সভাপতি সনিয়া গাঁধী এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আরেকটি ছবিতে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ মুখোমুখি কথা বলছেন। তৃতীয় ছবিতে দেখা যায়, সীতারাম কথা বলছেন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে। চতুর্থ ছবিটিতে দেখা যায়, সিপিএমের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের মুখে লাড্ডু গুঁজে দিচ্ছেন রাজনাথ। পিছনে জ্বলজ্বল করছে বিজেপির নির্বাচনী প্রতীক পদ্মফুল। একগাল হাসি এবং মুখে কটাক্ষ নিয়ে ডেরেক বলেন, ‘‘এই ছবিটা আমার সবচেয়ে পছন্দ!’’
বিরাট পদ্মফুলের ছবির সামনে রাজনাথের হাত থেকে কারাটকে লাড্ডু খেতে দেখে ভ্রূ কোঁচকান অনেক সিপিএম নেতাই। ওই ছবি কয়েক মুহূর্তে ‘ভাইরাল’ হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। গুঞ্জন তৈরি হয় রাজ্য-রাজনীতিতে।



সন্ধ্যার পরেই ‘রহস্য’ ফাঁস করেন বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। তিনি এক টিভি চ্যানেল মারফত একটি ছবি দেখিয়ে দাবি করেন, কারাটকে লাড্ডু খাওয়ানোর যে ছবিটি ডেরেক দেখিয়েছেন, সেটি পুরোপুরি ‘জাল’। সিদ্ধার্থনাথ এবং ডেরেকের দেখানো ছবি দু’টি হুবহু এক। ফারাক শুধু এক জায়গাতেই— সিদ্ধার্থনাথের দেখানো ছবিতে কারাটের জায়গায় নরেন্দ্র মোদী। সিদ্ধার্থনাথ জানান, ওই ছবিটি তোলা হয়েছিল ২০১৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। যেদিন মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে বেছে নিয়েছিল বিজেপি। আদতে ছবিটি তোলা নয়াদিল্লিতে বিজেপি’র কেন্দ্রীয় দফতরে।
সিদ্ধার্থনাথ আরও জানান, ছবিটিতে মোদীর মুখ সরিয়ে কারাটের মুখ ‘ফটোশপ’ করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বস্তুত, দু’টি ছবির মধ্যে পার্থক্য বলতে দু’টি মুখেরই। পোশাক এক। আবহ এক। এমনকী, দু’জন ব্যক্তিত্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে-থাকা নিরাপত্তারক্ষীও এক! এর পরেই ডেরেকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার হুমকি দেন সিদ্ধার্থনাথ। দ্রুত তৃণমূল তথা ডেরেকের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় শুরু হয় বঙ্গ-রাজনীতিতে। নয়াদিল্লি থেকে বিবৃতি দেন কারাটও। যেখানে তিনি বলেন, ‘‘রাজনাথের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ এখনও পাইনি। এটা একটা আদ্যন্ত নকল ছবি!’’

তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তৃণমূলের সরকারি টুইটার হ্যান্ডলে লেখা হয়— ‘সাংবাদিক বৈঠকে দু’টি ভিডিও এবং ছ’টি ছবি দেখানো হয়েছিল। একটি ছবি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ছবিটি যে আদতে ফটোশপের মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল, তা জানার পরই তৃণমূলের রিসার্চ টিমের সদস্যেরা সেটি সরিয়ে নিয়েছেন।’ রাতে ডেরেক তাঁর ফেসবুকে একটি ভিডিও আপলোড করেন। সেখানে তিনি টুইটারে দেওয়া বিবৃতির পাশাপাশি সরাসরি ‘ভুল’ স্বীকার করেছেন। এবং বলেছেন, ‘আমরা সম্মানজনকভাবে আমাদের ভুলটা সংশোধন করেছি। কিন্তু একজন ক্যুইজমাস্টার হিসাবে আমার এবং আমার রিসার্চ টিমের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল। আমাদের এই ভুলটা করা উচিত হয়নি’।
কিন্তু ততক্ষণে কেলেঙ্কারি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। নারদ-ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর তাকে ‘জাল’ বলে দাবি করেছিলেন মমতা-সহ দলের শীর্ষনেতৃত্ব। সেই তৃণমূলেরই এক সাংসদ-নেতা সাংবাদিক বৈঠকে ঘটা করে একটি ‘জাল’ ছবি দেখানোয় রাজনীতির কারবারিদের একাংশের মধ্যে হাসাহাসি শুরু হয়। একান্ত আলোচনায় শাসকদলের নেতাদের কয়েকজনও বলে ফেলেন, ‘অবিবেচকের মতো’ এবং ‘শিশুসুলভ’ কাজ করেছেন ডেরেক। এক নেতার কথায়, ‘‘যতটা উঁচুতে উড়ছিলেন ডেরেক, ততটাই নীচে নেমে এসেছেন। অতি চালাকের গলায় দড়ি!’’
প্রসঙ্গত, ডেরেক এদিন জানিয়েছিলেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই সাংবাদিক বৈঠকটি ডেকেছেন। ফলে গোটা ঘটনাটির সঙ্গে ডেরেক জড়িয়ে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতাকেও। তাঁর ওই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতৃত্ব। নির্বাচন যখন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পর্যায়ে, তখন ডেরেকের এই ‘অবিবেচনাপ্রসূত’ কাজ মুখ্যমন্ত্রীর উপর ‘চাপ’ আরও বাড়াবে বলেই ধারণা তাঁদের। সে যতই ডেরেক তৃণমূলের ‘রিসার্চ টিমে’র উপর ‘দায়’ চাপিয়ে সাধু সাজার চেষ্টা করুন না কেন! 


EmoticonEmoticon