হিংসা রুখতে চরম হুমকি

আগামিকাল , সোমবার রাজ্যে পঞ্চম দফার ভোট৷ তার দু'দিন আগে পুলিশ ও ভোটকর্মী -সহ রাজ্য প্রশাসনকে কড়া বার্তা দিল নির্বাচন কমিশন৷ নজিরবিহীন ভাবে দিল্লির নির্বাচন কমিশন থেকে রীতিমতো প্রেস বিবৃতি জারি করে শনিবার জানানো হয়েছে , অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট করাতে ব্যর্থ হলে , রাজ্যে ভোটের বাকি তিন পর্বে হিংসা থামাতে না -পারলে এবং হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দ্রুত আইনি ব্যবস্থা না -নিলে দায়িত্বে থাকা অফিসারদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে৷ নবান্নের শীর্ষকর্তাদের ব্যাখ্যা , এই বক্তব্যের অর্থ, ভোটের কাজে গাফিলতি কিংবা দলদাসত্বের নজির সামনে এলে এ বার সরাসরি দাগ পড়বে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের সার্ভিসবুকে৷


কমিশন জানিয়ে দিয়েছে , আগামী তিন পর্বে পুলিশ কর্তৃপক্ষ ও গোটা নির্বাচন মেশিনারিকে হিংসা থামিয়ে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট করাতেই হবে৷ প্রতিটি থানা এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ কমিশন এই হুমকিও দিয়েছে , ভোটের আগে , নির্বাচনের সময় ও পরে যে হিংসা হয়েছে ও হবে , তার উপর তারা কড়া নজর রেখেছে এবং রাখবে৷ অপরাধীরা যে দলের সঙ্গেই যুক্ত হোক না কেন , তাদের ছাড়া হবে না৷ পুলিশ ও রাজ্য প্রশাসন সময় নষ্ট না -করে এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে৷ হিংসা থামাতে ব্যর্থ হলে কমিশন যে ভাবে অফিসারদের শাস্তি দেওয়ার কথা বলেছে , তা অভূতপূর্ব৷ অতীতে এ ভাবে কোনও অফিসারকে শাস্তি দেয়নি বা দেওয়ার কথা সাধারণত বলেনি কমিশন৷ এই ধরনের ব্যবস্থা অন্য কোনও রাজ্যের ক্ষেত্রে কমিশন সচরাচর নেয় না৷ এমনকি , রাজ্যেও এর আগে যে চার দফায় ভোট হয়েছে , সেখানেও এ রকম কথা বলতে শোনা যায়নি নাসিম জাইদিদের৷ কিন্ত্ত যথেষ্ট পরিমাণ ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও গত পর্বে নির্বাচন চলাকালীন ও তার পরে হিংসায় চার জন মারা গিয়েছেন৷ কমিশন সমালোচনার মুখে পড়ায় জাইদি এই চরম ব্যবস্থাটাই নিলেন৷

কমিশন সূত্র বলছে , ২১ এপ্রিল চতুর্থ দফার ভোটের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন৷ এ দিন দিল্লির নির্বাচন সদন থেকে জারি করা এক প্রেস বিবৃতিতে কমিশনের অধিকর্তা ধীরেন্দ্র ওঝা স্পষ্ট করে দিয়েছেন , সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের ব্যাপারে পান থেকে চুন খসলে আর রেয়াত করা হবে না সংশ্লিষ্ট সরকারি আধিকারিকদের৷ সেটা সরাসরি কর্তব্যে অবহেলা হিসেবেই বিবেচিত হবে এবং সে গাফিলতির প্রভাব পড়বে তাঁদের চাকরির ক্ষেত্রেও৷ পুলিশ প্রশাসন , সাধারণ প্রশাসন , এমনকি কেন্দ্রীয় বাহিনীর কর্তা-আধিকারিকরাও এর আওতার বাইরে নয় বলে সাফ জানানো হয়েছে কমিশনের তরফে৷ কাল রাজ্যে পঞ্চম দফার ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করতে মরিয়া কমিশন আরও একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷

পুলিশ পর্যবেক্ষকের সংখ্যা ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর সংখ্যা বাড়ানো , কঠোর ভাবে ১৪৪ ধারা কার্যকর করা , কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহলদারি বাড়ানো , কোথায় কোথায় টহলদারি হবে তা নিয়ে পুলিশ পর্যবেক্ষকের সিদ্ধান্তই চড়ান্ত বিবেচনা করা এবং স্পর্শকাতর ও ঝামেলাপ্রবণ এলাকায় বিশেষ টহলদারির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ শুধু ভোট নয় , নির্বাচন -পরবর্তী হিংসা ঠেকাতেও কমিশন কড়া বার্তা দিয়েছে রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিককে৷ প্রতিটি ঘটনার উপর কমিশনের কড়া নজর রয়েছে জানিয়ে এ ব্যাপারে তাঁদের আরও দায়বদ্ধ করতে চেয়েছে কমিশন৷ তৃতীয় দফার ভোটের আগেই রাজ্যে এসে কমিশনের ফুল বেঞ্চ ডিজি -কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল , এই মুহূর্তে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ২৮ -এ ধারায় ডিজি কমিশনের ডেপুটেশনে রয়েছেন এবং রাজ্যে নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় অঘটনের দায় প্রত্যক্ষ ভাবে তাঁর৷ কলকাতার পুলিশ কমিশনারের পাশাপাশি পাঁচ জন এসপি , চার জন ডিএম -কে অপসারণ করিয়েও ক্ষান্ত হয়নি কমিশন৷

দুই জেলার যে ৪৯টি কেন্দ্রে কাল ভোট , শনিবার সন্ধ্যা ছ 'টা থেকেই সেখানে ১৪৪ ধারা জারি হয়ে গিয়েছে৷ যে দুই জেলায় ভোট , সেই হাওড়া ও উত্তর ২৪ পরগনায় বাড়ানো হয়েছে পুলিশ পর্যবেক্ষক৷ দুই জেলাতেই এ যাবত্ একজন করে পুলিশ পর্যবেক্ষক ছিলেন৷ রাজ্যের অতিরিক্ত মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক দিব্যেন্দু সরকার এ দিন বলেন , হাওড়ায় এ বার দু'জন এবং উত্তর ২৪ পরগনায় তিন জন পুলিশ পর্যবেক্ষক থাকবেন৷ হাওড়ায় রবি ভার্মাকে এবং উত্তর ২৪ পরগনায় প্রমোদ ভামরে এবং পি রামজিকে আনা হচ্ছে৷ সূত্রের খবর , কলকাতা উত্তরে পুলিশ পর্যবেক্ষক হিসেবে ভালো কাজ করার জন্য প্রমোদকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বিধাননগর , রাজারহাট -নিউ টাউন ও রাজারহাট -গোপালপুর বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে৷ গত বিধাননগর পুরভোটে এই তিন এলাকায় শাসক দল গায়ের জোরে ভোট করিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল৷ হাওড়ার শহর এলাকার জন্য ৭৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী ও ৩ হাজার রাজ্য পুলিশ এবং গ্রামীণ এলাকার জন্য ১৫২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী ও ৫ হাজার রাজ্য পুলিশ ইতিমধ্যেই মোতায়েন হয়ে গিয়েছে৷ তারা এলাকায় এলাকায় টহল দিচ্ছে৷

উত্তর ২৪ পরগনাতেও একই ছবি৷ ব্যারাকপুর কমিশনারেট এলাকায় ১৩৭ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী ও ৫০০০ রাজ্য পুলিশ থাকছে৷ বিধাননগর কমিশনারেট এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকছে ৫১ কোম্পানি এবং রাজ্য পুলিশ ২০০০৷ জেলার বাদবাকি অংশের গ্রামীণ এলাকায় ২৫৭ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী ও ৮ হাজার রাজ্য পুলিশ মোতায়েন হচ্ছে৷ গোলমালের আশঙ্কা রয়েছে এমন এলাকা ইতিমধ্যেই চিহ্নিত হয়েছে কমিশন ও পুলিশ প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে৷ এমন এলাকার সংখ্যা উত্তর ২৪ পরগনায় ২,৩২৩ এবং হাওড়ায় ৬৪৩টি৷ উত্তর ২৪ পরগনায় ৩ ,৭৮১ জন এবং হাওড়ায় ১ ,৭০৩ জন ভীতসন্ত্রস্ত ভোটারকেও চিহ্নিত করেছে কমিশন৷ এ ছাড়াও এলাকার গুন্ডা -মস্তান -সমাজবিরোধীদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন৷ উত্তর ২৪ পরগনায় এমন ৮৭৬ জন ও হাওড়ায় এমন ৬৬১ জনকে সতর্কতামূলক ভাবে গ্রেন্তার বা আটক করার নির্দেশও কমিশনের তরফে দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ প্রশাসনকে৷

দিল্লির কমিশন সূত্রে খবর , উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার উপর বিশেষ নজর দিচ্ছে কমিশন৷ নজর থাকবে হাওড়া ও হুগলির দিকেও৷ অনুব্রত মণ্ডলের মতো আরাবুল ইসলামের উপরও বিশেষ নজর থাকবে কমিশনের৷ হাওড়া ও হুগলির ক্ষেত্রেও তাঁদের প্রচুর চিন্তা রয়েছে৷ সংবাদপত্রের খবর , সিপিএমের বিস্তারিত অভিযোগ , পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্ট পাওয়ার পরই জাইদিরা চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে কমিশন সূত্রের খবর৷ 


EmoticonEmoticon