হারানোর জন্য পড়ে রয়েছে সর্বস্ব

জয় করার কিছু নেই। হারানোর জন্য পড়ে রয়েছে সর্বস্ব। আগামিকাল, সোমবার পঞ্চম দফার ভোটের আগে এই হল ‘দিদিজগতে’র ‘ক্যাচলাইন’!

জয় করার কিছু নেই। হারানোর জন্য পড়ে রয়েছে সর্বস্ব। আগামিকাল, সোমবার পঞ্চম দফার ভোটের আগে এই হল ‘দিদিজগতে’র ‘ক্যাচলাইন’!
উত্তর ২৪ পরগনায় ৩৩টি আসন এবং হাওড়ায় ১৬টি— সোমবার রাজ্যের যে ৪৯টি আসনে ভোট হতে চলেছে, তাতে ২০১১ সালে তৃণমূল (কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে) পেয়েছিল মোট ৪৪টি আসন। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের ফলাফল বলছে, তখনও তৃণমূল এগিয়েছিল মোট ৪৪টি আসনেই। 
সংখ্যার বিচারে মোট ৪৪। আসনের নামের নিরিখে খানিক এদিক-ওদিক। যেমন হাওড়ায় ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে ১৬টির মধ্যে ১৫টি আসনই পেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একটি জোটসঙ্গী কংগ্রেস। উত্তর ২৪ পরগনার ৩৩টি আসনের মধ্যে তৃণমূল প্রথমে পেয়েছিল ২৮টি আসন। পরে উপনির্বাচনে জিতে আরও একটি। অর্থাৎ, সোমবারের ভোটে যাওয়ার সময় উত্তর ২৪ পরগনায় ২৯টি আসন নিয়ে নামছেন মমতা। কংগ্রেস এবং বিজেপি একটি করে। বামেরা দু’টি। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের নিরিখে দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল এগিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার ২৮টি আসনে। বামেরা দু’টি এবং বিজেপি তিনটি আসনে। হাওড়ার ১৬টি আসনেও এগিয়ে ছিল তৃণমূল। 
অর্থাৎ, হরেদরে সেই ৪৪!
অর্থাৎ, ৪৯টি আসনের মধ্যে কার্যত নতুন করে জেতার কিছু নেই মমতার। কিন্তু তাঁর হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে বেশ কয়েকটি আসন। 
রাজ্যে সাত দফা ভোটের মধ্যে চারটি দফা ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। বাকি আরও তিনটি দফা। চার দফায় ভোট হয়েছে ১৬৭টি আসনে। বাকি আরও ১২৭টি আসনের ভোট। অর্থাৎ, ‘দিদি’র স্লগ-ওভার শুরু হয়ে যাচ্ছে সোমবারেই। তৃণমূলের অন্দরের এক ‘ভোট বিশেষজ্ঞে’র দাবি ওই ১৬৭টি আসনের মধ্যে অন্তত ৯৫টি আসন পাবেন তাঁরা। যদিও তাঁর সহকর্মীরাই তা মানতে নারাজ। তাঁদের এবং এমনকী, রাজ্য প্রশাসনেরও একাংশের মতে, ওই চার দফায় বড়জোর ৭০ থেকে ৮০টি আসন পেতে পারে শাসকদল। সেক্ষেত্রে ‘ম্যাজিক ফিগার’ ১৪৮টি আসনে পৌঁছতে গেলে বাকি ১২৭টি আসনের মধ্যে তৃণমূলকে আরও অন্তত ৮০টি আসন পেতেই হবে! অর্থাৎ, ‘স্ট্রাইক রেট’ ৮০ শতাংশ রাখলেও তৃণমূল সংখ্যাগরিষ্ঠ নাও-হতে পারে। 
ঘটনা হল, যে ১২৭টি আসনে এখনও ভোট বাকি (উত্তর ২৪ পরগনা এবং হাওড়ার ৪৯টি আসন ধরে), সেখানে তৃণমূলের ‘রক্তক্ষরণে’র সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, এর মধ্যে বেশিরভাগ আসন শহুরে এলাকায়। এর মধ্যেই রয়েছে কলকাতার চারটি আসন এবং কলকাতার লাগোয়া দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া এবং হুগলির আসনগুলি। যা শহুরে অথবা মফস্সল এলাকা। যেখানে নারদ-কাণ্ডের ‘প্রভাব’ পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। 
কারণ, ওই আসনগুলির মধ্যে একটিতে প্রার্থী সারদা-কাণ্ডে জেলবন্দি মদন মিত্র। যাঁকে আবার ‘নারদনিউজে’র গোপন ক্যামেরা অভিযানেও টাকা নিতে দেখা গিয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনারই বারাসতের সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার। তিনিও নারদ-কাণ্ডে অভিযুক্ত। পেশায় চিকিৎসক কাকলিকে অবশ্য ‘দিদি’ তাঁর ‘প্রিয় কাকলি’ বলেই সম্প্রতি প্রকাশ্যে অভিহিত করেছেন। যেমন তিনি ‘পাশে’ রয়েছেন মদনেরও। 
উত্তর ২৪ পরগনার মধ্যে আছে বিধাননগরও। যেখানে গত পুরভোটে অবাধ ছাপ্পাভোট ও নাগরিক-নিগ্রহের পর থেকে সিঁটিয়ে তৃণমূল। রয়েছে রাজারহাট-নিউটাউন। যেখানে সিন্ডিকেট-দৌরাত্ম্যে দীর্ণ তৃণমূলের গায়ে কালির দাগ লেগেছে। 
অতএব, ‘উত্তুরে হাওয়া’য় জ্বর আসার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। 
আবার হাওড়ার সাংসদ প্রাক্তন ফুটবলার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জেলার উলুবেড়িয়ার সাংসদ সুলতান আহমেদও নারদ-কাণ্ডে অভিযুক্ত। বস্তুত, তাঁর ভাই খানাকুলের বিধায়ক ইকবাল আহমেদই ছদ্মবেশী সাংবাদিক ম্যাথু স্যামুয়েলকে দলের বিভিন্ন নেতার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিরোধীদের দাবি, দুই জেলারই কলকাতা-লাগোয়া শহুরে এলাকায় ঘুষ-কাণ্ডের প্রভাব পড়তে বাধ্য। 
ফলে আগামী দু’টি দফার ভোট মমতার পক্ষে ‘সমস্যা-সংকুল’। একেবারে শেষদফায় গিয়ে তৃণমূল ঢুকবে তাদের ‘দুর্গ’ পূর্ব মেদিনীপুরে। তা-ও সেখানে অন্তত দু’টি আসনে হারের পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছেন দলীয় নেতাদের একাংশ। 
প্রকাশ্যে অবশ্য নিশ্চিন্তে আদা-চা’য়ে চুমুক দিচ্ছেন তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পর্যবেক্ষক তথা রাজ্যের বিদায়ী মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক (দিদির ‘বালু’)। শনিবেলায় তাঁর হিসাব, ‘‘অন্তত ৩১টা তো হবেই। ৩২টাও হতে পারে।’’ তাঁর নিজের কেন্দ্র হাবরা নিয়ে নিশ্চিন্ত বালু। শুধু তা-ই নয়, দলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের ভিত্তিতে জেলায় তাঁর সহযোদ্ধাদের ব্যাপারেও ‘গ্যারান্টি’ দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘উত্তুরে হাওয়া’য় কারও জ্বর-টর আসবে না! 
দলের একাংশ অবশ্য সারদা-কেলেঙ্কারির ‘প্রভাব’ নিয়ে চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না। কারণ, এই অর্থলগ্নি সংস্থার প্রতারণায় উত্তরের তিনটি মহকুমা বারাসত, বনগাঁ ও বসিরহাট মহকুমায় বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। 
এবং নারদ-কাণ্ড!
জেলায় দলের প্রধান হিসাবে বালুর অবশ্য দাবি, ‘‘একটা আসনেও ওই ভিডিও ফুটেজের কোনও প্রভাব নেই।’’
কারণ, তাঁর কথায়, ‘‘সারদা বা নারদ নিয়ে মানুষ ভাবছেন না। বনগাঁ থেকে বিধাননগর বা বীজপুর থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। তাতেই বিরোধীরা হারিয়ে যাবে।’’ 
উত্তরে এবার দেগঙ্গা, হাড়োয়ার মতো কয়েকটি কেন্দ্রে প্রার্থী বদল করেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে না তৃণমূল। বেশ খানিকটা নড়বড়ে বসিরহাট মহকুমার দু’টি আসনও। ব্যারাকপুর মহকুমাতেও দলের অভ্যন্তরীণ বিন্যাসের ছায়া রয়েছে অন্তত তিন-চারটি কেন্দ্রে। বালু যা প্রকাশ্যে বলতে পারছেন না, উত্তর ২৪ পরগনার সংখ্যালঘু ভোটারেরা তাঁদের থেকে সরে যাচ্ছেন বলে আশঙ্কায় রয়েছে শাসকশিবির। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের উর্দুভাষী মুসলিম তো বটেই, প্রত্যন্ত এলাকার বঙ্গভাষী সংখ্যালঘু ভোটারেরাও বিভিন্ন কারণে তৃণমূলের উপর বিরক্ত। যার উপর ভিত্তি করে সিপিএমের এক জেলানেতা বলছেন, ‘‘এখনই সংখ্যা বলছি না। কিন্তু উত্তর ২৪ পরগনায় বিরোধী জোটের আশাতীত ভাল ফল হবে।’’ যা ওই সিপিএম নেতা ভেঙে বলেননি— কংগ্রেসের হাত ধরে জেলায় সংখ্যালঘু ভোট ফেরানোর আশা করছেন তাঁরা।
উত্তর ২৪ পরগনায় আরও একটি ‘শক্ত জমি’তে ফাটল ধরেছে তৃণমূলের। এই জেলা থেকেই  মতুয়া সম্প্রদায়ের নতুন ‘ভোটব্যাঙ্ক’ আবিষ্কার করেছিলেন মমতা। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পর থেকেই সেই ভোটে ‘ভাঙন’ শুরু হয়। মতুয়া সম্প্রদায়ের মূল শক্তিকে দলের সঙ্গে রাখলেও তাতে ভাগ বসে গিয়েছে। নানাভাবে তা জোড়ার চেষ্টা করলেও মতুয়াদের উপর আগের মতো তৃণমূলের ‘একচ্ছত্র প্রভাব’ নেই বলে দাবি বিরোধীদের। 
হাওড়া জেলার সংখ্যালঘু ভোটারেরাও তৃণমূল সম্পর্কে ‘বীতশ্রদ্ধ’ বলেই দাবি বিরোধী জোটের। পাশের জেলা হুগলির ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা ত্বহা সিদ্দিকি লাগাতার বিরোধিতা করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতার। সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে লাভ হয়নি। জেলার এক গুরুত্বপূর্ণ দলীয় প্রার্থীর কথায়, ‘‘নির্বাচনের একেবারে মুখে এসে চাপ নিশ্চয়ই কিছুটা বেড়ে গিয়েছে।’’ 
দলের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে হাওড়ায় সমস্যা গোড়া থেকেই। বালি এবং উত্তর হাওড়ায় দুই ‘অরাজনৈতিক’ প্রার্থী নিয়ে আসায় দলের অন্দরে চোরাস্রোত রয়েছে। বালিতে তৃণমূল প্রার্থী করেছে প্রয়াত ক্রিকেট প্রশাসক জগমোহন ডালমিয়ার কন্যা বৈশালীকে। উত্তর হাওড়ায় দলের দীর্ঘদিনের নেতা তথা বিধায়ক অশোক ঘোষকে সরিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে প্রাক্তন ক্রিকেটার লক্ষ্মীরতন শুক্লকে। সেই ‘চর্চা’ এড়িয়েই কাজ করতে হয়েছে দুই কেন্দ্রের দলীয় নেতাদের।
শেষবেলায় ‘দিদি’র রক্তচাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে দলের মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের ছবি-কেলেঙ্কারি। যে ছবিতে বিজেপি-সিপিএমের ‘ঘনিষ্ঠতা’ প্রমাণে কম্পিউটারের কারসাজিতে নরেন্দ্র মোদীর মুখে সিপিএমের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের মুখ বসিয়ে কেল্লাফতে করতে চেয়েছিলেন ডেরেক। ধরা পড়ার পর তৃণমূলের আনুষ্ঠানিক ওয়েবসাইট থেকে ছবি তুলে নেওয়া হয়েছে বটে। কিন্তু তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে রাজ্য-রাজনীতিতে। বালুকে বলা গেল, কলকাতা-লাগোয়া দুই জেলায় ডেরেক-কাণ্ডের প্রভাব পড়লে তাঁর অঙ্ক প্রশ্নের মুখে পড়ে যেতে পারে!
শনিবেলায় বালুর আদা-চা’টা আর শেষ হল না! ‘প্রিয় কাকলি’ দিদির জ্বর আটকাতে পারবেন তো?


EmoticonEmoticon